এখন একটা ছোট বাচ্চাও জানে গ্র্যাভিটি বলে একটা ব্যাপার আছে। এই গ্র্যাভিটির কারনেই গাছ থেকে আম মাটিতে পড়ে, উপর থেকে কোনো বস্তু ছেড়ে দিলে সেটা নিচের দিকে অর্থাৎ পৃথিবীর দিকে পতনশীল হয়। কিন্তু প্রাচীন গ্রীক জ্ঞানী মানুষরা এই গ্র্যাভিটি বা মহাকর্ষের কথা জানতেন না। তাঁরা বিচিত্রসব ব্যাখ্যা দিতেন।
অন্তত এখনকার মাপকাঠিতে সেগুলো বিচিত্র তো বটেই। তাঁরা বলতেন- কিছু কিছু জিনিস যেমন গরম বাতাস বা ধোঁয়া এসব উপরে উঠে এবং কিছু কিছু জিনিস যেমন কোনো পাথর বা ভারী বস্তু এসব নিচে পড়েঃ এর কারন হচ্ছে এদের উপরে উঠার বা নিচে পড়ার সহজাত প্রবণতা (built in desire to rise or fall). তাঁরা বস্তুগুলোর এই ধর্মকে যথাক্রমে ‘Levity’ এবং ‘Gravity’ নামে নাম দেন। কিন্তু কোনো কিছুর নাম দেয়া গেলেই কিন্তু সেটা ব্যাখ্যা করা হয় না। এর অনেক শতাব্দী পর গ্যালিলিও এ নিয়ে অনেক দূর অগ্রসর হন এবং তারপর নিউটন পৃথিবী ও অন্য কোনো বস্তুর মধ্যকার আকর্ষন বলের কথা বলেন এবং একে গ্র্যাভিটি বলে নাম দেন। নিউটন বলেন যে শুধু পৃথিবী এবং অন্য বস্তুর মধ্যে নয়, অন্য সকল বস্তুর মধ্যেই এই বল কাজ করে। যেটাকে আমরা বলি Universal Gravitation বা মহাকর্ষ। এরপর গত শতাব্দীতে বিজ্ঞানী আইনস্টাইন স্পেশাল এবং জেনারেল রিলেটিভিটির মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ধারণা আরো বিস্তৃত ও পরিপূর্ণ করেন। এখন আমরা  জানি কিভাবে একাধিক বস্তুকণার মধ্যে আকর্ষন বল কাজ করে। তবে  এখনো আমরা জানি না কেন এই আকর্ষণ বল কাজ করে।
এতটুকু কথায় আমরা খুব সংক্ষেপে মহাকর্ষ বলের ইতিহাস জানলাম। কিন্তু এখানে আরো বিশাল ঘটনা প্রবাহ আছে। এই লেকচারে সেই ঘটনা প্রবাহের খানিকটা জেনে  মহাকর্ষ বল সম্পর্কে হাতেখড়ি নেব।  কিছুটা গল্পের মত করেই জানব মহাকর্ষ বলের ব্যাপারটি ধরতে পারার আগ পর্যন্ত নানা সময়ের বিজ্ঞানী জ্যোতির্বিদেরা কি কি প্রচেষ্টা ও পর্যায়ের মধ্য দিয়ে গেছেন।
আগে মনে করা হত পৃথিবীই সৌরজগতের কেন্দ্র। গ্রহ-উপগ্রহ-নক্ষত্র এসবের গতি ব্যাখ্যা করার জন্য তখন প্রয়োজন হয়েছিল জটিল জটিল হিসাব-নিকাশ। তখন মহাকর্ষ বলের কোনো ধারনা ছিল না। পরবর্তীতে কোপার্নিকাস, টাইকো ব্রাহে, কেপলার, গ্যালিলিও, নিউটন এবং অনেক পরে আইন্সটাইনের হাত ধরে আরো পাকাপোক্ত হয় মহাকর্ষের ধারনা। তবে এই ধারনা পাকাপোক্ত হবার আগ পর্যন্ত পেরিয়ে এসেছে এক দীর্ঘ ইতিহাস। গ্যালিলিও, নিউটনদের অবদান জানার আগে আমরা প্রাচীন জ্যোতির্বিদদের ধারনা সম্পর্কে জেনে নিই।
প্রাচীনকালের সাহিত্য আর বইপত্র পড়লে জানা যায় তারা পৃথিবীকে সমতল ভাবতেন। ভাবতেন পৃথিবী গতিহীন- স্থির। তারা মনে করতেন পৃথিবী দেখতে অনেকটা সমতল চাকতির মত- যেন অনেকটা অসীম জলরাশির উপর ভাসমান কর্ক। তবে মানুষ ধীরে ধীরে তার ভুল ধারনা পালটাতে পেরেছে। সমুদ্রে যখন মানুষ দূরে জাহাজের দেখা পেত তখন দেখা যেত দূর থেকে আসা জাহাজের উঁচু উপরের অংশটুকু আগে নজরে আসে। তারপর আস্তে আস্তে বাকি অংশটুকু দেখা যায়। আবার চন্দ্রগ্রহনের সময় মানুষ খেয়াল করে দেখেছে চাঁদের উপর পৃথিবীর যে ছায়া পড়ে তা গোলাকার। এভাবে বিভিন্ন প্রাকৃতিক ঘটনা খেয়াল করে করে মানুষ বুঝতে পেরেছে যে পৃথিবী সমতল নয় গোলাকার। আরেকটা ধারণা প্রতিষ্ঠিত ছিল যে পৃথিবীই সবকিছুর কেন্দ্রে। গ্রহ,নক্ষত্র,সূর্য সবকিছুই পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। আসলে মধ্যযুগের শেষ পর্যন্ত গ্রীক দার্শনিক গুরু এরিস্টটল আর গ্রীক-মিশরীয় গণিতবিদ টলেমীর পৃথিবীকেন্দ্রিক মতবাদ মানুষের মনে ‘প্রায় স্থায়ী’ হয়ে গিয়েছিল। এই মতবাদ এরিস্টটলের আগে প্লেটোও তাঁর ছাত্রদের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচার করেছিলেন।

এরিস্টটল মনে করতেন পৃথিবীই সৌরজগতের কেন্দ্র
গ্রীক মহাজ্ঞানী এরিস্টটল
টলেমী পৃথিবী কেন্দ্রিক সৌরজগতের একটা মডেল দেন
টলেমী
টলেমী ১৪০ খ্রিস্টাব্দে একটি ভূকেন্দ্রিক মডেল দেন। টলেমীর এই মতবাদ প্রায় তেরশ বছর মানুষের মাঝে টিকে ছিল। তবে খ্রিস্টপূর্ব যুগে (খ্রিস্টপূর্ব ৩১০-২৩০) গ্রীক জ্যোতির্বিদ এরিস্টার্কাস এরিস্টটলের মতবাদের বিরোধীতা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন সূর্য নয় পৃথিবীই সূর্যের চারদিকে ঘুরে, যদিও তিনি তাঁর বক্তব্যের স্বপক্ষে কোনো গাণিতিক বিশ্লেষণ দিতে পারেননি। এরিস্টার্কাসের অনেক কথাই পরবর্তীতে সঠিক বলে প্রমাণিত হয়েছিল। কিন্তু তখন কেউ তাঁর কথা গ্রহণ করেনি। এর কারণ ছিল এরিস্টটলীয় প্রভাব। এরিস্টটল তখন ছিলেন মহাজ্ঞানীর মত। তাঁর যেকোনো কথা সবাই এক বাক্যে মেনে নিত। সমাজে তাঁর প্রভাব ছিল সীমাহীন। তাঁর অনুরাগীর সংখ্যাও ছিল অনেক বেশী। ফলে এরিস্টটেলের বিরুদ্ধাচরণ করে তখন কোনো কিছু প্রতিষ্ঠা করা যেত না।

নিকোলাস কোপার্নিকাস। যিনি শক্তভাবে প্রথমবারের মত টলেমী মডেলের বিরোধীতা করেন
এরপর শক্তভাবে যিনি টলেমীর ভূকেন্দ্রীয় মতবাদকে চ্যালেঞ্জ করেন তিনি হলেন নিকোলাস কোপার্নিকাস (খ্রিস্টাব্দ ১৪৭৩-১৫৪৩) যিনি  শুরু থেকেই টলেমীর ভূকেন্দ্রিক মতবাদের বিরোধীতা করে আসছিলেন। তিনি বুঝতে পারেন পৃথিবীকে সরিয়ে সূর্যকে সৌরজগতের কেন্দ্রে রেখে খুব সহজেই টলেমীর মডেলের অনেক সমস্যা সমাধান করা যায়। এ সম্পর্কিত প্রথম বইটি কোপার্নিকাস লিখেন ১৫৩০ সালে। কিন্তু বইটি তখন প্রকাশ করা হয়নি। এরপর অনেক দিন পর ১৫৪৩ সালে অনেক সীমিত আকারে প্রকাশ করা হয়। যেখানে প্রকাশক গ্রন্থাকার কোপার্নিকাসের অনুমতি ছাড়াই লিখে দেন এই বইয়ের মতবাদ যেন কোনো আক্ষরিক মতবাদ হিসেবে না দেখা হয়। এটিকে যেন কেবল একটি বিকল্প চিন্তা হিসেবে ধরা হয়। বইটি তাই মানুষের উপর তেমন একটা প্রভাব ফেলতে পারেনি।
এ তো গেল কোপার্নিকাসের কথা। এ প্রসংগে টাইকো ব্রাহে (খ্রিস্টাব্দ ১৫৪৬-১৬০১) এবং তাঁর সহকারী কেপলারের (খ্রিস্টাব্দ ১৫৭১-১৬৩০) কথাও উল্লেখ করতে হবে। টাইকো ব্রাহে ১৫৭৬ সালে ডেনমার্কের রাজা ফ্রেডরিক ২ এর দেয়া দ্বীপ ভেন (Hven) এ খুব চমৎকার একটি জ্যোতির্বিজ্ঞান পর্যবেক্ষন কেন্দ্র গড়ে তোলেন। দীর্ঘ ২০ বছর সেখানে তিনি গ্রহ-নক্ষত্রের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ ও রেকর্ড করেন। পরবর্তীতে নতুন ডেনীশ রাজা ক্রিশ্চিয়ানের সাথে বনিবনা না হওয়ায় ১৫৯৭ সালে প্রাগে চলে আসেন। সেখানে তিনি বোহেমিয়ার রাজা রুডলফের রাজসভার অফিসিয়াল জ্যোতির্বিদ হিসেবে নিয়োজিত হন। সেখানে ১৬০০ সালে উনিশ বছর বয়সী জার্মান জোহানেস কেপলার (খ্রিস্টাব্দ ১৫৭১-১৬৩০) তাঁর এসিস্ট্যান্ট হিসেবে নিয়োজিত হন। এতদিনের পর্যবেক্ষন সত্যেও ব্রাহে পৃথিবীকেই সৌরজগতের কেন্দ্র হিসেবে ভাবতেন। কিন্তু ব্রাহের বহুদিনের জমানো ডাটা-উপাত্ত-তথ্য ব্যাখ্যা করার জন্য কেপলার সূর্য-কেন্দ্রিক মডেলের ব্যাপারে উৎসাহী হন। তিনি গণিত এবং জ্যামিতির সাহায্যে গ্রহগুলোর দূরত্ব ও গতি সম্পর্কে ব্যাখ্যা দেন। অনেক গাণিতিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে তিনি গ্রহদের গতি সম্পর্কিত তিনটি সূত্র দেন যা বিখ্যাত কেপলারের সূত্র নামে পরিচিত। এই কোর্সে আমরা কেপলারের সূত্র সম্পর্কে পরে জানব। আপাতত আমরা আরেকটু ইতিহাস জানি।

চেক প্রজাতন্ত্রের রাজধানী প্রাগ শহরে টাইকো ব্রাহে এবং তাঁর এসিস্ট্যান্ট জোহানেস কেপলারের মূর্তি

গ্যালিলিও গ্যালিলেই। পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে প্রধানতম বিজ্ঞানীদের একজন।
এতক্ষণ প্রাচীন থেকে মধ্যযুগ পর্যন্ত পৃথিবীর আকার গোলাকার না সমতল, ভূকেন্দ্রিক মডেল, সৌরকেন্দ্রিক মডেল ইত্যাদি নিয়ে অনেক কথা বলা হল। আপাতভাবে মহাকর্ষ সূত্র আবিষ্কারের সাথে এদের অপ্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে। কিন্তু আসলে তা নয়। এরপরে ইতিহাসের দৃশ্যপটে আসেন গ্যালিলিও গ্যালিলেই (খ্রিস্টাব্দ ১৫৫৮-১৬৪২). তিনি তাঁর পূর্বসূরীদের রেখে যাওয়া কাজ বিশদভাবে স্টাডি করেন। তাঁর নিজস্ব পর্যবেক্ষণ এবং আগেরকার জ্যোতির্বিদদের রেখে যাওয়া কাজ থেকে তিনিও বুঝতে পারেন পৃথিবী সৌরজগতের কেন্দ্রে নয়। ইতিমধ্যে ঘটে যায় এক ন্যাক্কারজনক ঘটনা। জিওর্দানো ব্রুনো (খ্রিস্টাব্দ ১৫৪৮-১৬০০) নামের এক জ্যোতির্বিদকে কোপার্নিকাসের সৌরকেন্দ্রিক মতবাদ সমর্থন করার অপরাধে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়। বার বার মত পরিবর্তনের চাপ-হুমকি উপেক্ষা করে ব্রুনো সত্যের প্রতি অবিচল থাকেন। ফলে তাঁকে জীবিত অবস্থায় পুড়ে মরার ভাগ্য বরণ করতে হয়।


রোম শহরে জিওর্দানো ব্রুনোর ব্রোঞ্জের মূর্তি

ব্রূনোর বিচার চলছে। ক্যাম্পো ডি ফিওরি স্কয়ার, রোমে একটি ব্রোঞ্জের শিল্পকর্ম
১৬০০ সালের সেই ব্রুনোর কাহিনী হিসেব করলে গ্যালিলিওর সূর্যকেন্দ্রিক মতবাদের প্রতি সমর্থন ছিল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। তারপরো ১৬১০ সালে তিনি কোপার্নিকাসের সৌরকেন্দ্রিক মতবাদের পরোক্ষ সমর্থনে বই লেখেন। নানা বাধা উপেক্ষা করে তিনি তাঁর মতবাদ প্রচার করতে থাকেন। ১৬৩২ সালে গ্যালিলিও আরেকটি বিখ্যাত বই লেখেন। বইটি সাধারণ মানুষের জন্য তিনি সহজ ভাষায় লেখেন। সেখানে তিনি তিনটি কাল্পনিক চরিত্রের সৃষ্টি করেন। তিনটি চরিত্র হল সালভিয়াতি যিনি কোপার্নিকাসের সূর্যকেন্দ্রিক মতবাদের সমর্থক, সিম্পিসিও- এরিস্টটলীয় পৃথিবী কেন্দ্রিক মতবাদের সমর্থক, আর পরের জন- সাগ্রেদো ছিলেন নিরপেক্ষ। বইটিতে চরিত্র তিনটির কথোপকথনের মাধ্যমে দেখানো হয় যুক্তির দিক দিয়ে কোপার্নিকাসের সমর্থক চরিত্রের কাছে এরিস্টটলীয় মতবাদের সমর্থক চরিত্রটি পেরে উঠছেন না। বইটি লেখা হয়েছিল ইতালীয় ভাষায়। যার নাম ইংরেজীতেঃ  ‘Dialogue concerning the two chief systems of the world: the Ptolemic and the Copernican’। বাংলায়ঃ বিশ্ব জগতের দুটি প্রধান সিস্টেম সম্পর্কে কথোপকথন, টলেমিক এবং কোপার্নিকান জগত। বইটিতে খুব প্রাঞ্জল ভাষায় জনসাধারনের বোধগম্য করে তিনজন চরিত্রের কথোপকথনের মাধ্যমে কোপার্নিকাস মতবাদের বিপরীতে টলেমী মতবাদের দুর্বলতা প্রকাশ করা হয়েছিল। বস্তুত এটা ছিল সৌরকেন্দ্রিক মতবাদের পক্ষে জনসাধারণের কাছে গ্যালিলিওর একধরনের প্রচার। ১৬৩৩ সালে কর্তৃপক্ষ আবার তাঁকে সৌরকেন্দ্রিক মতবাদ প্রচার করার ফলে ধর্মদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত করল। বাধ্য করা হল মত বদলাতে। ১৬৪২ সালে বন্দী অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্তও তিনি সৌরকেন্দ্রিক মতবাদে অবিচল ছিলেন। বিজ্ঞানের ইতিহাসে গ্যালিলিও খুব গুরুত্বপূর্ণ নাম। সৌরকেন্দ্রিক মতবাদ ছাড়াও তাঁর অনেক গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে। নিউটনের আগ পর্যন্ত পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে তিনি ছিলেন প্রধানতম বিজ্ঞানীদের একজন। এখনো তাই আছেন। তিনি একাধারে পদার্থবিদ, গণিতবিদ, জ্যোতির্বিদ ও দার্শনিক ছিলেন।
স্যার আইজ্যাক নিউটন। মেকানিক্সের জনক। শ্রেষ্ঠতম বিজ্ঞানীদের একজন।
গ্যালিলিওর মৃত্যুর বছরই (১৬৪২) জন্ম নেন মহান বিজ্ঞানী স্যার আইজ্যাক নিউটন (খ্রিস্টাব্দ ১৬৪২-১৭২৭). পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রভাবশালী এবং শ্রেষ্ঠতম বিজ্ঞানীদের একজন তিনি। নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র নিয়ে একটি গল্প প্রচলিত আছে। বলা হয়ে থাকে তিনি আপেল গাছের নিচে বসে ছিলেন। একটা আপেল নিচে পড়ল। তাঁর মাথায় সাথে সাথে চিন্তা এল আপেল নিচে পড়ল কেন। আপেলটি নিচে পড়ল কেন এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই তিনি মহাকর্ষ সূত্রের ব্যাপারটি ধরতে পারেন। আসলে এই গল্প অনেকটা ‘মিথ’-এর মত। ইতিহাসবিদদের নিজস্ব সৃষ্টিও হতে পারে। তবে সত্য ঘটনাগুলো এরকমঃ তখন নিউটন ছিলেন ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ১৬৬৫ সালে প্লেগ মহামারী আকারে দেখা দেয়। প্লেগ রোগটা ছিল এমন যে একজনের হলে তা আশেপাশের সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ত।  প্লেগের প্রকোপে বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি দিয়ে দেয়া হয়। নিউটন ছুটিতে চলে যান তাঁর গ্রাম উলসথ্রোপে। এই অবসরের সময়টা তিনি গণিত, বলবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা, অপটিক্স (আলোকবিজ্ঞান), নানা ধরনের এক্সপেরিমেন্ট ইত্যাদিতে ব্যয় করেন। এইসময়েই তাঁর মাথায় প্রথম মহাকর্ষের ধারণাটি আসে। নিউটনের জীবনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐ ছুটিটা পৃথিবীবাসীর জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ঐ ছুটিতে পাওয়া অবসর তাঁকে অনেক নির্ভারভাবে চিন্তা-ভাবনার সুযোগ করে দিয়েছিল। অনেক গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজ তিনি ঐসময়টাতে করেছিলেন। প্লেগের প্রকোপ কমে আসলে ১৬৬৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেয়া হয়। নিউটন ফিরে আসেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৬৬৯ সালে মাত্র সাতাশ বছর বয়সে তিনি কেমব্রিজে লুকাসিয়ান অধ্যাপক পদে নিযুক্ত হন। তাঁর আগে এই পদে সর্বপ্রথম ছিলেন আইজ্যাক ব্যারো। ক্যামব্রিজে এই পদটি এখনো আছে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ গণিতবিদ ও পদার্থবিদ এই পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন যাদের মধ্যে চার্লস ব্যাবেজ, পল ডিরাক, স্টিফেন হকিং প্রমুখ ছিলেন। বর্তমানে এই পদে আছেন তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী মাইকেল গ্রীন।
খুব অবাক করা ব্যাপার হল মহাকর্ষ আবিষ্কারের মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি বিজ্ঞানী নিউটন বিশ বছর জনসমক্ষে আনেন নি। ১৬৮৭ সালে বিখ্যাত ‘ফিলোসফিয়া ন্যাচারালিস প্রিন্সিপিয়া ম্যাথমেটিকা’ বইতে প্রথম তাঁর ঐ আবিষ্কারের বিষয়টি প্রকাশ করেন।  বইটিকে সংক্ষেপে ‘প্রিন্সিপিয়া’ বলা হয়। বইটি ১৬৮৭ সালের ৫ই জুলাই প্রকাশিত হয়। পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তিনটি বিষয় এতে আলোচিত হয়ঃ নিউটনের গতিসূত্র যা চিরায়ত বলবিজ্ঞানের ভিত্তি স্থাপন করে, সার্বজনীন মহাকর্ষ তত্ত্ব এবং কেপলারের গ্রহীয় গতি সম্পর্কিত সূত্রের প্রমাণ। প্রিন্সিপিয়াকে বিজ্ঞানের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী বইগুলোর একটি হিসেবে ধরা হয়। এই বইটির মাধ্যমে নিউটন তত্ত্বীয় ও গাণিতিক পদার্থবিদ্যার দৃঢ় ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করলেন। বইটি প্রকাশের ক্ষেত্রে নিউটনের বন্ধু বিজ্ঞানী হ্যালীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। তিনিই এই বইটি প্রকাশের জন্য নিউটনকে ক্রমাগত অনুরোধ করেন এবং আর্থিক সাহায্য দেন।
নিউটনের মহাকর্ষ আবিষ্কারের কাহিনী বলার আগে আমরা আরো অনেক ইতিহাস জেনে এসেছি। তার একটা কারণ আছে। চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র এদের গতি প্রকৃতিকে বোঝার জন্য প্রাচীন কাল থেকে মধ্যযুগ পর্যন্ত নানা সময়ের নানা জ্যোতির্বিদেরা নানা তত্ত্ব দিয়ে এসেছেন, নানা মতবাদ দিয়ে নানাভাবে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কোনোটাই পুরোপুরি সঠিক ছিল না। মহাকর্ষ আবিষ্কারের মাধ্যমে এই ব্যাখ্যাগুলো সঠিকভাবে দেয়া গেল। গ্রহ-উপগ্রহ-নক্ষত্র এদের গতিপ্রকৃতি ব্যাখ্যা করা গেল। সূর্য ও চন্দ্র গ্রহনের ব্যাখ্যা ও পূর্বাভাস দেয়া গেল। এ তত্ত্বের সাহায্যেই বোঝা যাচ্ছে পৃথিবীর উপর বিভিন্ন বস্তুর গতিবিধির এবং নানা ঘটনার। কেন আপেল মাটিতে পড়ে, কেন জোয়ার-ভাটা হয়। এ তত্ত্বের মাধ্যমেই আমরা বলতে পারছি কিভাবে মহাশুন্যে মহাকাশযান পাঠাতে হয়, কিভাবে কৃত্রিম উপগ্রহ স্থাপন করতে হয়, কিভাবে মিসাইল ছুড়তে হয় এবং এমন আরো নানাকিছু। মহাবিশ্বের সব বস্তুই যে একই নিয়ম মেনে চলে, আকাশ আর পৃথিবী যে এক নিয়মে বাঁধা এটা নিউটনের আগে এমনভাবে আর কেউ বলতে পারেননি।
নিউটন সর্বশ্রেষ্ঠ পদার্থবিজ্ঞানীদের একজন। তিনি মেকানিক্সের জনক। লিবনিজের পাশাপাশি তিনিও পৃথক ভাবে গণিতের শক্তিশালী শাখা ক্যালকুলাস আবিষ্কার করেন। ক্যালকুলাস ছাড়াও গণিতে তাঁর অনেক মৌলিক অবদান আছে। শব্দবিজ্ঞান ও আলোকবিজ্ঞানেও তাঁর বড় অবদান রয়েছে। এক্সপেরিমেন্টাল কাজেও তাঁর অনেক সফল পরীক্ষা আছে। এক জীবনে নিউটন অনেক কিছু করে গেছেন। এত এত অবদানের পরও মৃত্যুর কিছুকাল আগে তিনি বলে গিয়েছিলেনঃ
‘আমি জানি না বিশ্বের কাছে আমি কিভাবে উপস্থাপিত হয়েছি। কিন্তু আমার কাছে মনে হয় এক ছোট বালক যে কেবল সমুদ্র উপত্যকায় খেলা করছে এবং একটি ক্ষুদ্র নুড়ি বা ক্ষুদ্রতর এবং খুব সাধারণ পাথর সন্ধান করছে, অথচ সত্যের মহাসমুদ্র তার সামনে পড়ে রয়েছে যা অনাবিষ্কৃতই রয়ে গেল।’
আমরা মহাকর্ষ আবিষ্কারের ইতিহাস সম্পর্কে অনেক কিছু জানলাম। এবারে মহাকর্ষ বল সম্পর্কে জানব। এটা খুবই চমকপ্রদ একটা ব্যাপার। প্রথম শুনলে বিশ্বাস হতে চায় না। এই সূত্র বলেঃ ভর আছে এমন যেকোনো বস্তু ভরযুক্ত অন্য যেকোনো বস্তুকে আকর্ষণ করে। প্রথমবার যে কেউই এই কথাটা শুনলে একটু অবাক হবে। বাস্তব জীবনে আমরা এই আকর্ষনের বিষয়টা টের পাই না। আগে থেকে না জেনে থাকলে দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে এই মহাকর্ষ বলের বিষয়টি ধরতে পারা সম্ভব নয়। অন্তত কল্পনা করা সহজ নয়।

মহাকর্ষ বলের ব্যাপারটা ভালভাবে চোখে পড়ে যখন বিশাল ভরের কোনো বস্তু (বিশাল ভর বলতে এখানে পৃথিবীর মত বিশাল ভর বা এরকম বিশাল ভরের সাথে তুলনা করা যায় এমন ভরের কথা বলা হয়েছে) আশেপাশে আসে। ভরযুক্ত প্রতিটি বস্তু অপর বস্তুকে আকর্ষণ করছে মহাকর্ষ বল দ্বারা। এই আকর্ষন বল নির্ভর করে বস্তু দুটির ভর এবং এদের মধ্যকার দূরত্বের উপর। কিভাবে এই আকর্ষণ বল ভর এবং দূরত্বের উপর নির্ভর করে সেটা গাণিতিকভাবে বলার জন্য আমরা m1 এবংm2 ভরের দুইটি বস্তু কল্পনা করে নেই। আরো ধরে নেই এদের মধ্যকার দূরত্ব d এবং আকর্ষণ বলের মান F.  আপাতত এখানে বস্তু দুটিকে গোলাকার বিবেচনা করেছি এবং এখানে দূরত্ব হিসেব করা হয়েছে গোলাকার বস্তু দুটির কেন্দ্র থেকে। এক্ষেত্রে বস্তু দুটির মধ্যকার আকর্ষণ বলঃ  F=G(m1m2/d2)
F1=F2 অর্থাৎ দুটো বস্তুই পরস্পরকে সমান বলে আকর্ষণ করছে, যদিও ভরদ্বয় কিন্তু সমান না।

এই আকর্ষণ বল এদের কেন্দ্র বরাবর কাজ করে। এখানে G হল মহাকর্ষ ধ্রুবক। এর মান 6.67×10-11Nm2kg2
N বলের একক নিউটনকে প্রকাশ করছে, m দূরত্বের একক মিটার এবং kg ভরের একক কিলোগ্রাম-কে প্রকাশ করছে।
এখানে ‘মহাকর্ষ ধ্রুবক আমরা কিভাবে বের করলাম’ আপাতত এই প্রশ্ন সরিয়ে রাখি। নিউটন নিজেও এই মহাকর্ষ ধ্রুবকের মান জানতেন না। কারণ তখন এই বল পরিমাপ করার কোনো উপায় জানা ছিল না। তাই দুটি নির্দিষ্ট ভরের বস্তুর নির্দিষ্ট দূরত্বে থাকা অবস্থায় এদের মধ্যকার মহাকর্ষ বল ঠিক কত হবে সেটা তখন বের করা সম্ভব হয়নি। তবে তিনি গাণিতিকভাবে এই মহাকর্ষ বল ভর ও দূরত্বের সাথে কিভাবে সম্পর্কিত সেটা দেখিয়েছিলেন। এক্সপেরিমেন্টালি প্রথম মহাকর্ষ ধ্রুবকের মান বের করেন বিজ্ঞানী হেনরী ক্যাভেন্ডিশ। তাও সেটা মহাকর্ষ আবিষ্কার হবার পর প্রায় ১১০ বছর পরে। সুযোগ হলে এই এক্সপেরিমেন্টটার কথা পরে এই কোর্সে মহাকর্ষ বিস্তারিতভাবে পড়ানোর সময় বলা যাবে।
F=G(m1m2/d2)
গাণিতিকভাবে লেখা এই সূত্রটা দেখে বেশ কিছু জিনিস চিন্তা করার আছে। বস্তু দুটির ভরের গুণফল হচ্ছে m1m2. এই গুণফল যদি দ্বিগুন হয়ে 2m1m2 হয় তাহলে এদের মধকার বল ও দ্বিগুন হয়ে 2F হবে। ভরের গুণফল তিনগুণ হয়ে 3m1m2 হলে বল হবে 3F। 4m1m2 হলে বল হবে 4F। এভাবে চলবে এবং এটা এভাবেই পরিবর্তন হয় যেটাকে আমরা বলি সমানুপাতিক পরিবর্তন। অর্থাৎ বস্তুদ্বয়ের মধ্যকার মহাকর্ষ বলের পরিমান এদের ভরের গুণফলের সমানুপাতিক।
এবার দূরত্বের বিষয়টা চিন্তা করি। দূরত্ব দ্বিগুণ হলে আকর্ষণ বল হয়ে যাবে আগের চার ভাগের এক ভাগ অর্থাৎ (1/4) গুণ। দূরত্ব তিনগুণ হলে বল হবে আগের নয় ভাগের এক ভাগ অর্থাৎ (1/9) গুণ। এভাবে চারগুণ হলে বল হবে আগের (1/16) গুণ। এটা এভাবে চলবে এবং এভাবে পরিবর্তন হওয়াকে বলের বর্গের ব্যস্তানুপাতিক পরিবর্তন। অর্থাৎ বস্তুদ্বয়ের মধ্যকার বল এদের দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতিক।
নিচের টেবিলটাতে কথাগুলো একসাথে করা হলঃ

বল ভরদ্বয়ের গুণফলের সমানুপাতিক, বস্তুদ্বয়ের দূরত্বের বর্গের ব্যাস্তানুপাতিক।


ভর এবং দূরত্ব পরিবর্তনের প্রভাব

ভর এবং দূরত্বের উপর এই নির্ভরশীলতা একই সঙ্গে কাজ করে। অর্থাৎ ভরের গুণফল যদি আগের তুলনায় দ্বিগুণ হয় এবং দূরত্ব যদি তিনগুণ হয় তাহলে মধ্যকার বল হবে আগের  (2/9) গুণ। বাকী পরিবর্তনগুলোও একই নিয়মে হবে। এখানে একটা কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে। দূরত্ব ওবং ভর যাই হোক না কেন দুটি বস্তুই পরস্পরকে সমান বলে আকর্ষণ করছে। দুটি বস্তুর একটি যদি পৃথিবী হয় এবং অন্যটি যদি আপেল হয় তবে পৃথিবী আপেলকে যে বলে আকর্ষণ করছে আপেলও পৃথিবীকে একই বলে আকর্ষণ করছে। প্রশ্ন হচ্ছে বল একই হলেও আপেল কেন পৃথিবীর দিকে ছুটে যায় পৃথিবী কেন আপেলের দিকে ছুটে যায় না। এর কারণ হচ্ছে পৃথিবীর বিশাল ভর এবং পৃথিবীর ভরের তুলনায় আপেলের নগন্য ভর। আকর্ষণ বলের কারণে আপেলের মধ্যে যে ত্বরণ হয় সেটা আমরা খুব সহজেই দেখতে পারি। কিন্তু একই পরিমাণ বল পৃথিবীর উপর কাজ করলেও পৃথিবীর ভর অনেক অনেক বেশী হওয়ায় এর মধ্যে ত্বরণের পরিমাণ খুবই কম হয়।  বিশ্বাস করতে কষ্ট হলেও মনে রাখতে হবে পৃথিবীরও এক্ষেত্রে খুব খুব অল্প হলেও খানিকটা ত্বরণ হয়েছিল।
বাম দিকের বস্তুটাকে পৃথিবীর ভরের সাথে তুলনীয় কোনো বস্তু এবং ডান দিকের বস্তুটাকে পৃথিবী বলে বিবেচনা করি। পৃথিবীর ভরের সাথে তুলনীয় কোনো বস্তু যদি পৃথিবীর দিকে পতিত হয় তখনই কেবল ঐ বস্তুটার ত্বরণের পাশাপাশি পৃথিবীর ত্বরণও আলাদা করে দেখা যাবে। ধুসর কালির বৃত্তটা তাদের আগের অবস্থান নির্দেশ করছে।
একটা উদাহরণ দিয়ে বোঝানো যেতে পারে। একটা ছোট খেলনা গাড়ি আর একটা সত্যিকারের বিশাল বড় ট্রাক গাড়ি আছে। উভয়ের উপরই সমান বল প্রয়োগ করা হল। তাহলে একই পরিমাণ বল প্রয়োগ করা সত্ত্বেও অবশ্যই খেলনা গাড়ির ত্বরণ ঐ ট্রাকের তুলনার অনেক অনেক বেশীই হবে। (ধরে নেই খেলনা গাড়ি ও ট্রাকের উপর বিপরীত দিক থেকে ঘর্ষণ বল কাজ করে নেট বল শুন্য করে দেয়নি)

যে মহাকর্ষ বল আপেলকে পৃথিবীর দিকে টানে সেই একই মহাকর্ষ বল চাঁদকে পৃথিবীর চারদিকে ঘোরায়

পৃথিবী ও তার চারপাশের পার্থিব বস্তুর মধ্যকার আকর্ষন বলের তুলনায় পৃথিবী পৃষ্ঠে বা পৃষ্ঠের কাছাকাছি অন্য বস্তুগুলোর তাদের মধ্যকার আকর্ষন বল নগন্য। এর কারণ পৃথিবীর ভরের তুলনায় পৃথিবী পৃষ্ঠে থাকা অন্যান্য বস্তুগুলোর ভর নগন্য। এ কারনে পৃথিবীর আকর্ষণ বল ছাড়া অন্য বস্তুগুলোর নিজেদের মধ্যকার আকর্ষণ বল সেভাবে আমাদের নজরে আসে না। আমরা অংক করতে গেলেই সেটা দেখব।  ধরি পৃথিবীর ভর m1, আপেলের ভর m2, একটা ক্রিকেট বলের ভর m3. আমরা জানি মহাকর্ষ বলের সূত্রটা হচ্ছেঃ F=G(m1m2/d2).
প্রথমে পৃথিবী এবং আপেলের মধ্যকার বলটা হিসাব করি। ধরে নেই দূরত্বের কোনো পরিবর্তন এক্ষেত্রে হচ্ছে না। আপেলের ভর অনেক অনেক কম কিন্তু পৃথিবীর ভর অনেক অনেক বেশী। এই দুই ভর গুণ দিয়ে (m1m2) আমরা অনেক বড় একটা সংখ্যা পাব। কাজেই সেই হিসেবে বলও অনেক বেশী হবে।
এবার আপেল এবং ক্রিকেট বলটার কথা চিন্তা করি। ধরি এক্ষেত্রেও দূরত্ব আগেরটাই রয়ে গেছে, অর্থাৎ d. আপেল এবং ক্রিকেট বল এদের দুটিরই ভর পৃথিবীর ভরের তুলনায় অনেক অনেক কম। কাজেই এদের ভরের গুণফলও (m2m3) আগের গুণফল (m1m2)   এর তুলনায় অনেক অনেক কম হবে।
(m2m3) <<  (m1m2)
কাজেই দ্বিতীয় ক্ষেত্রে কাজ করা মহাকর্ষ বল প্রথম ক্ষেত্রের তুলনায় অনেক অনেক কম হবে।
পৃথিবী ও অন্য বস্তুর মধ্যকার আকর্ষণ বলকে অভিকর্ষ বলে। অভিকর্ষ এক প্রকার মহাকর্ষ।  মহাকর্ষ বল অন্যান্য মৌলিক বলের তুলনায়  অনেক দুর্বল।  (চার ধরনের মৌলিক বল আছে। মহাকর্ষ বল, তড়িৎ চৌম্বক বল, দুর্বল নিউক্লিয় বল, সবল নিউক্লিয় বল).  আগের ব্যাখ্যাটা ব্যবহার করে আমরা বলতে পারি একটা আপেলকে পৃথিবী যে বল দিয়ে আকর্ষন করে তার তুলনায় আমি আপেলটিকে যে বলে আকর্ষণ করছি সেটা খুবই নগন্য। কারন আমার তুলনায় পৃথিবীর ভর অনেক বেশী।  এখানে আমার থেকে পৃথিবী এবং পৃথিবী ও আপেলের মধ্যকার দূরত্ব প্রায় একই।  তার উপর পৃথিবী ও আপেলের ভরের গুণফলও অনেক বেশি। সেকারনে বলও অনেক বেশী। (উল্লেখ্য একই সঙ্গে আপেলটিও পৃথিবীকে এবং আমাকে আকর্ষণ করছে।) তাই আমরা দেখি আপেল পৃথিবীর দিকেই ছুটে যায়। যদিও আমার ও আপেলের মধ্যেও মহাকর্ষ বল কাজ করছে।
আজকের লেকচারে আমরা কেবল মহাকর্ষ বল এবং মহাকর্ষ সূত্রটি চিনে নিলাম। এ সম্পর্কে বিস্তারিত এবং সংশ্লিষ্ট আরো পড়াশুনা আছে। মোটামুটি আরো যেসব টপিক কভার করার আছে সেগুলো হলঃ
  1. নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র (এই লেকচারে আলোচনা করা হয়েছে। আবার আলোচনা করা হবে)
  2. মহাকর্ষীয় ধ্রুবক (সম্ভব হলে ক্যাভেন্ডিশের মহাকর্ষ ধ্রুবক বের করার পরীক্ষাটি সহ)
  3. ওজন ও ভর
  4. কেপলারের সূত্র
  5. মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র
  6. মহাকর্ষীয় বিভবশক্তি
  7. আপাত ওজন
পর্যায়ক্রমে টপিকগুলো আমাদের আলোচনায় আসবে। লেকচারের শুরুতে আমরা অনেক ইতিহাস জেনেছি। পৃথিবী কিংবা সূর্যকেন্দ্রিক  মডেল, গ্রহ-নক্ষত্রের গতিবিধি ব্যাখ্যার জন্য নানাসময়ের জ্যোতির্বিদ বিজ্ঞানীদের চেষ্টা সম্পর্কে জেনেছি। ১৬৮৭ সালে মহাকর্ষ সূত্র প্রকাশের আগে পর্যন্ত গ্রহ-উপগ্রহ গুলোর গতিবিধি সম্পর্কে অনেক তথ্যই পৃথিবীবাসীর কাছে ছিল। কিন্তু এদের গতির পেছনের বল কিভাবে কাজ করছে, এই বলের উৎস কি সেটা সম্পর্কে সঠিক ধারনা ছিল না। এজন্য সঠিক ব্যাখ্যাগুলো দেয়া যাচ্ছিল না। মেকানিক্সের ভিত্তি হিসেবে কাজ করা নিউটনের প্রিন্সিপিয়া বইতে দেয়া মহাকর্ষ সূত্র ও নিউটনের গতি সম্পর্কিত সূত্রগুলো দিয়ে এ ব্যাখ্যাগুলো ঠিক মত দেয়া গেল। দেখা গেল যে আকর্ষণ বলের কারণে গাছ থেকে আপেল পৃথিবী পৃষ্ঠে পড়ে সে একই আকর্ষণ বল চাঁদকে পৃথিবীর চারদিকে প্রায় বৃত্তাকার পথে ঘোরায়, গ্রহগুলো সূর্যের চারদিকে ঘোরে। কেবল পৃথিবী এবং অন্য বস্তু নয়, এই মহাকর্ষ বল সার্বজনীন। মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তুই একে অপরকে আকর্ষণ করছে। পৃথিবী ও চাঁদের মধ্যকার আকর্ষন বা সূর্য ও গ্রহগুলোর মধ্যকার আকর্ষণ এই সার্বজনীন মহাকর্ষ বলেরই বিশেষ রূপ।

0 মন্তব্য(গুলি) to স্কুলের পদার্থবিদ্যা লেকচার ৮- (মহাকর্ষ)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Blogger দ্বারা পরিচালিত.

Ads

Social Icons

Featured Posts