প্রতিদিনকার জীবনে আমরা শক্তির উৎস হিসেবে অনেক কিছুর কথা চিন্তা করি।
গাড়ি চালাতে কিংবা তাপ উৎপন্ন করতে আমাদের জ্বালানী লাগে, বৈদ্যুতিক
যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে বিদ্যুত লাগে, দেহের শক্তি যোগাতে খাদ্য লাগে। এই
জ্বালানীগুলো আমাদের এমন কিছু একটার যোগান দেয় যেটা দিয়ে আমরা উপরের
কাজগুলো করতে পারি। এ থেকে আমরা ধারনা করে নিতে পারি যে জ্বালানী থেকে
পাওয়া ঐ কিছু একটাই হল শক্তি। কথাটা হয়ত ঠিক।
আমাদের এই ‘কিছু একটা’র বাইরে পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় শক্তিকে কিভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয় সেটাও জানতে হবে।
প্রতিটি প্রাকৃতিক ঘটনার পেছনেই আছে শক্তি এবং শক্তির এক রূপ থেকে অন্য রূপে রূপান্তর হওয়া। শক্তির ধারনা বিজ্ঞান ও প্রকৌশলে খুব গুরুত্বপূর্ণ। তবে শুধু সংজ্ঞা দিয়ে শক্তির ধারনা বা শক্তির ধারনার গুরুত্বটা হয়ত পুরোপুরি বোঝা যাবে না। মোট শক্তির পরিমান নির্দিষ্ট। প্রতিটি প্রাকৃতিক ঘটনায় শক্তি কেবল একরূপ থেকে অন্য রূপে পরিবর্তিত হয়। এক বস্তু যে পরিমান শক্তি হারায় অপর বস্তু ঠিক সেই পরিমান শক্তি লাভ করে। এই রূপান্তর কিভাবে ঘটছে, কিভাবে কোন শক্তি অন্য কোন শক্তিতে রূপান্তরিত হচ্ছে এই বিষয়গুলোও আলোচনা করতে হবে। প্রথম প্রথম শক্তির ধারনা একটু এবসট্রাক্ট মনে হলেও আমরা যখন আমরা প্রাকৃতিক ঘটনাগুলোর পেছনে শক্তির রূপান্তরগুলো ব্যাখ্যা করতে পারব তখন শক্তির ধারনা কি, কিভাবে এটা গুরুত্বপূর্ণ এই ব্যাপারগুলো আরো ভালভাবে বুঝতে পারব।
তবে শুধু প্রাকৃতিক ঘটনাই না। বিভিন্ন মেকানিক্যাল সিস্টেম ডায়নামিক্স ব্যাখ্যা করতেও শক্তির ধারনা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এই অধ্যায়ে আসার আগ পর্যন্ত আমরা বেগ, ত্বরন, বল, নিউটনের সূত্রসমূহ ইত্যাদি বিষয় শিখব। কিন্তু তারপরো দেখা যাবে যে কিছু কিছু সমস্যা সমাধানে কেবল এই ধারনাগুলোই যথেষ্ঠ হচ্ছেনা কিংবা খুব সহজে সমস্যাগুলো সমাধান করা যাচ্ছে না। আরো কিছু ধারনার প্রয়োজন হচ্ছে। এজন্য এই অধ্যায়ে আমাদের পদার্থবিজ্ঞানের পড়াশুনায় কাজ, শক্তি, ক্ষমতা সম্পর্কিত ধারনাগুলোও যুক্ত হবে যেগুলো ব্যবহার করে গাণিতিক অনেক সমস্যা আরো সহজে সমাধান করা যাবে।
আমাদের বাসার আলমারীটাকে ঠেলে সরানো, রাস্তায় আটকে যাওয়া একটা গাড়িকে ঠেলা, এক বাক্স বই মেঝে থেকে উপরের সেলফে তোলা, এগুলো দৈনন্দিন জীবনে বেশ কষ্টসাধ্য কাজ। এই ঠেলা, এদিক সেদিক নাড়ানো, এরকম নানা কিছু করে একটু পরিশ্রম করাঃ প্রতিদিনকার জীবনে কাজ বলতে আমরা এই ব্যাপার গুলোকেই বুঝিয়ে থাকি। অর্থাৎ যেকোনো কিছু, যেটা করতে পেশি শক্তি কিংবা মানসিক চেষ্টার প্রয়োজন হয়। তবে দৈনন্দিন জীবনে কথা-বার্তায় ব্যবহৃত কাজ আর পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় ব্যবহৃত কাজের মধ্যে পার্থক্য আছে। কাজ করতে হলে শক্তি লাগে। এই শক্তির আবার নানা রূপ আছে। তাছাড়া কোনো কাজ কে কতটুকু সময়ের মধ্যে শেষ করল সেটার উপর নির্ভর করে কার ক্ষমতা কতটুকু। এই অধ্যায়ে আমরা পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় কাজ, শক্তি, ক্ষমতা, এদের সংজ্ঞা, এদের সাথে জড়িত নানা বিষয়াদি এবং এ সম্পর্কিত গাণিতিক সমস্যা সমাধান কিভাবে সমাধান করতে হয় সেসব জানব।
কাজ
ধরা যাক সকাল থেকে আমি একটা বড় ট্রাকে একটা একটা করে অনেকগুলো ইট উঠানোর কাজ করছি। এটা করতে করতে এক সময় আমি ক্লান্ত হয়ে পড়ব, আমার ক্ষিধা লাগবে। আরো শক্তি পাওয়ার জন্য তখন আমাকে খাবার খেতে হবে। যেভাবেই হোক না কেন এই খাবারে থাকা শক্তিই পরবর্তীতে ট্রাকের উপরে উঠানো ইটে সঞ্চারিত হয়েছে। আর এই প্রক্রিয়াটাতে আমরা ‘কাজ’ শব্দটা ব্যবহার করব যার মাধ্যমে খাবারে থাকা শক্তি আমার মধ্যে এবং পরে ইটের মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছে। এ থেকে একটা সাধারণ ধারণা পাওয়া যায় যে শক্তি এক রূপ থেকে অন্য রূপে পরিবর্তিত হয়। কাজ, শক্তি ও ক্ষমতা সম্পর্কিত এ অধ্যায়ে আমরা শক্তির রূপান্তর সম্পর্কেও ধারনা নেব।
দৈনন্দিন জীবন এবং পদার্থবিজ্ঞান এই দুই ক্ষেত্রেই কাজ শব্দটা ব্যবহৃত হয়। ইটগুলোকে ট্রাকের উপর তোলার ক্ষেত্রে আমরা কাজ করেছি। কিন্তু দৈনন্দিন জীবনে আরো অনেক সাধারণ প্রচেষ্টা বা ক্রিয়াকেও কাজ বলে চালিয়ে দেয়া হয়। যেমন সবাই বলে যে ভালমত পদার্থবিজ্ঞান শেখা অনেক কঠিন কাজ! সাধারণ কথাবার্তায় আমরা এরকম অনেক কিছুকেই কাজ বলে থাকি। কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানে কাজের সংজ্ঞা সুনির্দিষ্টভাবে দেয়া আছে।
ট্রাকে ইট তোলার ঘটনায় ফিরে যাই। ইট তুলি আর যাই তুলি না কেন, বস্তুটা যত বেশি ভারী হবে আমাদের তত বেশি কাজ করতে হবে। কাজটা আরো বেশি কঠিন হবে যখন আমাদের এটাকে আরো বেশি উপরে তুলতে হবে। স্বাভাবিকভাবে আইডিয়া করা যায় যে কতটুকু বল প্রয়োগ করে কতটুকু সরণ হল সেই পরিমান থেকে কাজের পরিমান সম্পর্কে জানা যায়। এই অবজারভেশান থেকেই কাজের সংজ্ঞা দেয়া হয়। আপাতত আমরা ধ্রুব বলের জন্য কাজ সংজ্ঞায়িত করছি। পরিবর্তনশীল বল দ্বারা কৃতকাজ হিসাব করতে হলে ক্যালকুলাস জানা থাকতে হবে। বল যদি ধ্রুব হয় তাহলে কাজের সংজ্ঞাটা হচ্ছেঃ
বল প্রয়োগের ফলে বস্তুর বলের দিকে সরণ হলে বল এবং সরণের গুণফলকে কাজ বলে। (আরো সঠিক সংজ্ঞাটা হলঃ কোনো বস্তুর উপর বল প্রয়োগে বস্তুর সরণ ঘটলে প্রযুক্ত বল ও বলের অভিমুখে সরণের উপাংশের গুণফলকে কাজ বলে। উপাংশ কথাটা নিয়ে বিচলিত হওয়ার দরকার নেই। এটা কেন, কি , কিভাবে এসেছে সেটা সময়মত জানা যাবে। ভেক্টর জানা থাকলে এটা কোনো বিষয়ই না। )
এই কথা থেকে একটা কথা স্পষ্ট যে কোনো বস্তুর উপরে শুধু বল প্রয়োগ করলেই কাজ হয় না। যেমন রাস্তায় আটকে যাওয়া একটা গাড়ির উপর বল প্রয়োগ করা হল। কিন্তু গাড়িটির কোনো স্থানান্তর হল না। সুতরাং প্রযুক্ত বল কোনো কাজ করল না। অতএব বস্তুর উপর বল প্রয়োগ করলে যদি বলের ক্রিয়া রেখায় ঐ বস্তুর স্থানান্তর না ঘটে তবে তা কাজ হয় না।
W=Fs
W= কাজ, F=বল, s=বলের দিকে সরণ
বল এবং সরণের দিক ভিন্ন হলে
W=Fs cosθ= বলের মান × বলের দিকে সরণের উপাংশের মান= সরণের মান × সরণের দিকে বলের উপাংশের মান
θ= বল এবং সরণের দিকের মধ্যকার কোণ।
কাজের একক জুল। 1 Joule= 1 Newton * 1 Meter. এটা একটা স্কেলার রাশি।
শুধুমাত্র তখনই কাজ হবে যখন বল প্রয়োগের ফলে বস্তুর বলের দিকে সরণ হয়। আমি একটা বাক্স হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছি। ভূমি থেকে একই উচ্চতায় অনেকক্ষণ ধরে রাখতে গিয়ে হয়ত আমাকে বল প্রয়োগ করতে হচ্ছে, কিন্তু এখানে কোনো কাজ হচ্ছে না। কারণ বাক্সটাতে বল প্রয়োগ করা সত্তেও (একটা হচ্ছে অভিকর্ষ বল যা নিচের দিকে কাজ করছে, আরেকটা হচ্ছে আমার হাত দিয়ে উপরের দিকে অভিকর্ষ বলের বিপরীত দিকে প্রয়োগ করা বল) এর উপর বা নিচ বরাবর কোনো সরণ না হওয়ার এখানে কোনো কাজ হচ্ছে না। অনেকক্ষন ধরে রাখার ফলে আমরা হয়ত ক্লান্ত হয়ে যেতে পারি। কিন্তু সেটা কেবলই আমার পেশির তন্তু গুলোর ক্রমাগত সংকোচন-প্রসারণের ফলে। এই পেশি সংকোচন-প্রসারনের ফলে যেটা হচ্ছে সেটা হল দেহের একটা অংশ আরেকটা অংশের উপর বল প্রয়োগ করে কাজ করছে। এজন্য আমরা ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছি। কিন্তু যেহেতু বাক্সর উপর বা নিচ বরাবর কোনো সরণ হচ্ছে না সেহেতু বাক্সটার উপর কোনো কাজ ও হচ্ছে না। রাস্তায় আটকে পড়া একটা গাড়িকে আমি অনেকক্ষন ধরে ঠেললাম। কিন্তু গাড়িটার কোনো সরণ হল না। এক্ষেত্রেও কোনো কাজ হবে না। আবার বল যদি সরণের লম্ব দিকে হয় তখনও কোনো কাজ হবে না। W=Fs cosθ এই সূত্রটা থেকে দেখা যায় যে θ যদি 900 বা 2700 হয় তাহলে cosθ=0 হবে এবং কাজও শুন্য। এই দুই মান ছাড়া (অর্থাৎ যখন বলের দিক ও সরণ পরস্পর লম্ব হয়) θ এর অন্য যেকোনো মানের জন্য ধনাত্মক বা ঋণাত্মক যেকোনো মান পাওয়া যাবে যদি F (বল ) এবং s (সরণ ) যেকোনো একটাও আলাদাভাবে শূন্য না হয়।
যে ব্যাক্তি বা বস্তু বল প্রয়োগ করে সেই ব্যাক্তি বা বস্তুই তখন কাজ করে যার উপর বল প্রয়োগ করা হয় সেই বস্তুর উপর। কাজ করার ফলে আসলে কি হয়? কাজ করার ফলে শক্তি এক বস্তু থেকে আরেক বস্তুতে সঞ্চারিত হয়। ধরা যাক আমি একটা বইকে মেঝে থেকে সেলফে তুললাম। এর ফলে বইয়ের উপর কাজ করা হল। এর ফলে বইটার মধ্যে কিছু একটা জমা হল। এখানে বইটার উপর কাজ করার ফলে যে কিছু একটা জমা হল সেটাই হল শক্তি। বইটা যদি নিচে পড়ে তাহলে এটা কাজ করতে পারবে, নিচে থাকা কোনো কিছুর উপর বল প্রয়োগ করে সেটাকে ‘নষ্ট/দুমড়ে-মুচড়ে দেয়া/কোনো ধরনের পরিবর্তন’ করতে পারবে। এই ক্ষেত্রে আমি বইটার উপর কাজ করার মাধ্যমে এর উপর শক্তি জমা করেছি- যার ফলে বইটার মধ্যে একটা সামর্থ্য জমা হল যেটা দিয়ে সে তার নিজের বা তার পরিবেশের মধ্যে পরিবর্তন আনতে পারবে।
কাজ করার মাধ্যমে আমি আমার দেহ থেকে বইটাতে শক্তি সঞ্চারিত করেছি। এভাবেও বলা যায় ‘কাজ হল এমন একটা মেকানিক্যাল মাধ্যম যার মাধ্যমে এক বস্তু থেকে অন্য বস্তুতে শক্তি সঞ্চারিত করা যায়’ (Work is the transfer of energy by mechanical means.) যখন আমি বল প্রয়োগ করে বইটাকে উপরে তুলব তখন আমার হাত বইটার উপর ধনাত্মক কাজ করল। এর ফলে আমার মধ্য থেকে বইয়ের মধ্যে শক্তি সঞ্চারিত হল। আবার বইটা যখন আমি হাতে ধরে নিচে নামাই তখন আমার হাত দ্বারা কৃতকাজটা হচ্ছে ঋণাত্মক।
ক্ষমতা
আমরা এতক্ষন কাজ সম্পর্কে অনেক কিছু বলেছি। কিন্তু কাজ করার সময় সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। দৈনন্দিন জীবনে আমরা দেখেছি যে কোনো নির্দিষ্ট কাজ কেউ তাড়াতাড়ি করতে পারে, কেউ হয়ত এতটা তাড়াতাড়ি করতে পারে না। আমি একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক ইট একই উচ্চতায় তুললাম ২০ মিনিট সময় ব্যয় করে। আরেকজন এই একই সংখ্যক ইট একই উচ্চতায় তুলল ১০ মিনিট সময় ব্যয় করে। তাহলে যে ১০ মিনিটে ঐ একই কাজটা করল তার ক্ষমতা বেশি। কারণ ফিজিক্সের ভাষায় ক্ষমতার সংজ্ঞা হচ্ছেঃ
একক সময়ে যে পরিমাণ কাজ হয় তাকে ক্ষমতা বলে।
ক্ষমতা (p) =কাজ (w)/ সময় (t); (p=w/t); ক্ষমতার একক ওয়াট (watt).
1 watt= 1 Joule/ 1 secend
শক্তি
শক্তি আসলে কি? দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ ধারণায় যার শক্তি যত বেশি সে তত বেশি কাজ করতে পারে। ধরা যাক আমি একটা দৌড় প্রতিযোগীতায় অংশ নিয়েছি। আমার যদি শক্তি বেশি থাকে তাহলে আমি আরো বেশি দ্রুত দৌড়ে আরো বেশি দূর যেতে পারব , কিংবা আরো বেশি উপরে লাফ দিতে পারব। বস্তু কিংবা ব্যাক্তি সবকিছুরই শক্তি আছে। আবার এই শক্তির নানা রূপও আছে। একটা বড় পাথরের টুকরা যখন অনেক উপর থেকে নিচে পড়ে তখন সেই পড়ন্ত পাথরের যথেষ্ট শক্তি আছে একটা গাড়ির সামনের অংশের কাচ ভেঙ্গে চুরমার করে দেবার জন্য। আমরা যখন ঢিল ছুড়ি সেই ঢিলেরও শক্তি আছে যেটা দিয়ে পাথরটা বাসা বাড়ির জানালার কাঁচ ভেঙ্গে দিতে পারে কিংবা আঘাত করে কোনো কিছু সরিয়ে দিতে পারে। সাধারণভাবে আমরা এভাবে বলতে পারি যে যদি কোনো বস্তু তার চারপাশের কিংবা তার নিজের কোনো পরিবর্তন করতে পারে তাহলে তার শক্তি আছে। এই অধ্যায়ের জন্য শক্তির সংজ্ঞাকে আমরা প্রচলিত ভাবেই সংজ্ঞায়িত করব। আর সেটা হচ্ছে ‘Ability to do work’ অর্থাৎ কাজ করার সামর্থ্যকে শক্তি বলে। তবে শক্তির বিভিন্ন রূপ আছে। সব ধরনের শক্তির জন্য এটাও খুব গ্রহনযোগ্য একটা সংজ্ঞা না। এই সংজ্ঞাটা মূলত যান্ত্রিক শক্তির জন্য প্রযোজ্য।
শক্তির বিভিন্ন রূপ আছে। কিন্তু কি সেই বিভিন্ন রূপ তার একটা ধারণা দেয়া দরকার। কোনো বস্তু তার নিজের বা চারপাশের পরিবেশের কোনো পরিবর্তন করতে পারলে ধরে নিতে হবে যে তার মধ্যে শক্তি আছে। ( energy is the ability to change an object or its environment) এখন এই পরিবর্তন অনেকভাবেই হতে পারে। একটা চলন্ত গাড়ি চলতে গিয়ে কোনো কিছুর সাথে ধাক্কা খেয়ে ঐ বস্তুর আকৃতি পরিবর্তন করে ফেলতে পারে। যে শক্তিটা গাড়িকে গতিশীল করছে সেই শক্তি সাধারণত গাড়ি চালানোর তেল বা গ্যাসোলিনের রাসায়নিক বন্ধনের মধ্যে সঞ্চিত থাকে। এই শক্তি আরো নানা ভাবে সঞ্চিত থাকতে পারে। একটা ভারী বস্তু অনেক উপরের শেলফে রাখা হলে সে বস্তুটার মধ্যে যথেষ্ট পরিমান বিভব শক্তি জমা হয়। বস্তুটা যখন নিচে পড়ে তখন এই সঞ্চিত বিভবশক্তি গতিশক্তিতে পরিবর্তিত হয় এবং নিচে যে বস্তুটার উপর পড়ে সেটার উপর কাজ করতে পারে। (এই অধ্যায়ের বিস্তারিত পড়া যখন আমরা পড়ব তখন আমরা গাণিতিকভাবে দেখব যে উপরে থাকা একটা বস্তু যখন ক্রমাগত নিচে পড়তে থাকে তখন উচ্চতার পরিবর্তনের সাথে সাথে এর বিভবশক্তি কিভাবে গতিশক্তিতে রুপান্তরিত হয়।) আবার একটা স্প্রিং বা রাবার ব্যান্ডকে টেনে ধরে ছেড়ে দিলে সেটা অন্য আরেকটা বস্তুকে গতিশীল করে দিতে পারে। তাহলে দেখা যাচ্ছে প্রসারিত বা টেনে ধরে রাখা স্প্রিং/রাবারের মধ্যেও এক ধরনের শক্তি জমা হয় যেটা অন্য বস্তুর উপর কাজ করতে পারে। শক্তির নানা রূপ আছে। এর মধ্যে বিশেষকরে বিভবশক্তি ও গতিশক্তি নিয়ে এই অধ্যায়ে আমরা আলোচনা করব।
পদার্থবিজ্ঞানে বিভবশক্তি (Potential energy) বলতে কোন বস্তু বা কোন ব্যবস্থা তার স্বাভাবিক অবস্থা বা অবস্থানের বা বস্তুর কণাসমুহের বিন্যাসের পরিবর্তনের জন্য কাজ করার যে সামর্থ্য অর্থাৎ শক্তি লাভ করে তা বোঝানো হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় বাহ্যিক বল প্রয়োগের মাধ্যমে স্প্রিং-এর একপ্রান্ত টেনে এর দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি করা হলে বা অভিকর্ষের বিরুদ্ধে কোন বস্তুকে ভূমি থেকে উত্তোলন করা হলে কোন বস্তু বিভবশক্তি অর্জন করে। বলের বিরুদ্ধে কাজ করে কোন বস্তুকে অন্য অবস্থা বা অবস্থানে আনতে যে পরিমান কাজ করা হয় তা বস্তুর মধ্যে বিভবশক্তি রূপে জমা থাকে। বস্তুটি যখন আবার তার পূর্বের অবস্থা বা অবস্থানে ফিরে আসে তখন বস্তুটির ঐ পরিমান বিভবশক্তি অন্য শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। অভিকর্ষজ বিভবশক্তি পরিমাপ করা হয় PE=mgh এই সূত্র দ্বারা। (PE= potential energy, m=ভর g=অভিকর্ষজ ত্বরণ h=উচ্চতা)
একটা চলন্ত বস্তু অন্য একটা বস্তুকে আঘাত করে সেই বস্তুর উপর কাজ করতে পারে। ধরা যাক একটা গাড়ি স্থির আছে। এখন আমরা ইঞ্জিন চালু করে এক্সিলেটার চেপে এর মধ্যে গতির সঞ্চার করলাম। গাড়ি চলছে। গতিশীল অবস্থায় গাড়িটির মধ্যে কাজ করার সামর্থ্য জমা হল। অর্থাৎ গাড়িটির মধ্যে শক্তির সঞ্চার হল। গতির ফলে কোনো বস্তুর মধ্যে যে শক্তি জমা হয় সেটাকে বলে গতি শক্তি। গাড়িটির বেগ এবং ভর জেনে এই গতিশক্তি সুনির্দিষ্টভাবে বের করা যায়।
লোহার বড় গোলা দিয়ে একটা ইটের দেয়ালকে আঘাত করলে সেটা ভেঙ্গে পড়ে, একটা হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে করে আমরা কাঠের মধ্যে পেরেক ঠুকি, একটা চলন্ত বস্ত আরেকটা বস্তুকে আঘাত করলে সেই দ্বিতীয় বস্তুটার কিছুটা সরণ ঘটে। তাহলে দেখা যাচ্ছে একটা চলন্ত বস্তু কাজ করতে পারে। এভাবেও বলা যায় যে চলন্ত বস্তুর কাজ করার সামর্থ্য আছে যেটাকে আমরা শক্তি বলি। চলন্ত বস্তুর এই গতিশীলতার জন্য এর মধ্যে যে শক্তির উদ্ভব হয় সেটাকে গতিশক্তি বলে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই যে চলন্ত গাড়ির মধ্যে শক্তি জমা হল, সেই শক্তি কোথা থেকে এল? এই শক্তি কিন্তু এমনি এমনি আসে নি। যদি এমনি এমনি আসত তাহলে গাড়ি চালানোর তেল-গ্যাস নিয়ে আমাদের কোনো দুশ্চিন্তাই থাকত না।
আমরা জানলাম যে গতি শক্তি কি। এবারে আমাদের জানতে হবে যে কিভাবে একটা চলন্ত বস্তুর গতিশক্তি হিসাব করা হয়। অর্থাৎ কত ভরের একটা বস্তু ঠিক কত বেগে চললে এর মধ্যে উদ্ভব হওয়া গতিশক্তির পরিমাণ কত। m ভরের একটা বস্তু যদি v বেগে সরলপথে চলে তাহলে এর গতি শক্তির পরিমাণ (1/2)mv2 . এই সূত্রটা আমরা হঠাৎ করে লিখে দেই নি। এর প্রতিপাদন আমরা পরে পড়ব। গতিশক্তি সংক্রান্ত বিভিন্ন গাণিতিক সমস্যা সমাধানে এই সূত্রটা আমাদের বার বার লাগবে।
এতটুকু পড়ার পর আমরা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা জিনিস শিখব। এটা হল কাজ-শক্তি উপপাদ্য। একটা বস্তুর উপর নেট যতটুকু কাজ করা হয় বস্তুটার গতিশক্তির ঠিক ততটুকু পরিবর্তন হয়।
আরেকটা গুরত্বপূর্ণ তথ্য হচ্ছে শক্তির সৃষ্টি কিংবা বিনাশ নেই। মহাবিশ্বের মোট শক্তির পরিমান নির্দিষ্ট। এটাকে বলা হয় শক্তির নিত্যতা সূত্র। শক্তি লেখচিত্র এবং পড়ন্ত বস্তুর ক্ষেত্রে বিভবশক্তি ও গতিশক্তির ক্রম রূপান্তরের গাণিতিক প্রমাণের মাধ্যমে এটা খুব সুন্দরভাবে করা যায়। কাজ, ক্ষমতা এবং শক্তির বিস্তারিত লেকচারগুলোতে এই নিয়ে আমরা অনেক মজার মজার বাস্তব উদাহরণ সহ আলোচনা করব।
এখানে নানা ঘটনায় শক্তির রূপান্তরের কিছু উ্দাহরণ দেয়া হলঃ
আমাদের এই ‘কিছু একটা’র বাইরে পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় শক্তিকে কিভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয় সেটাও জানতে হবে।
প্রতিটি প্রাকৃতিক ঘটনার পেছনেই আছে শক্তি এবং শক্তির এক রূপ থেকে অন্য রূপে রূপান্তর হওয়া। শক্তির ধারনা বিজ্ঞান ও প্রকৌশলে খুব গুরুত্বপূর্ণ। তবে শুধু সংজ্ঞা দিয়ে শক্তির ধারনা বা শক্তির ধারনার গুরুত্বটা হয়ত পুরোপুরি বোঝা যাবে না। মোট শক্তির পরিমান নির্দিষ্ট। প্রতিটি প্রাকৃতিক ঘটনায় শক্তি কেবল একরূপ থেকে অন্য রূপে পরিবর্তিত হয়। এক বস্তু যে পরিমান শক্তি হারায় অপর বস্তু ঠিক সেই পরিমান শক্তি লাভ করে। এই রূপান্তর কিভাবে ঘটছে, কিভাবে কোন শক্তি অন্য কোন শক্তিতে রূপান্তরিত হচ্ছে এই বিষয়গুলোও আলোচনা করতে হবে। প্রথম প্রথম শক্তির ধারনা একটু এবসট্রাক্ট মনে হলেও আমরা যখন আমরা প্রাকৃতিক ঘটনাগুলোর পেছনে শক্তির রূপান্তরগুলো ব্যাখ্যা করতে পারব তখন শক্তির ধারনা কি, কিভাবে এটা গুরুত্বপূর্ণ এই ব্যাপারগুলো আরো ভালভাবে বুঝতে পারব।
তবে শুধু প্রাকৃতিক ঘটনাই না। বিভিন্ন মেকানিক্যাল সিস্টেম ডায়নামিক্স ব্যাখ্যা করতেও শক্তির ধারনা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এই অধ্যায়ে আসার আগ পর্যন্ত আমরা বেগ, ত্বরন, বল, নিউটনের সূত্রসমূহ ইত্যাদি বিষয় শিখব। কিন্তু তারপরো দেখা যাবে যে কিছু কিছু সমস্যা সমাধানে কেবল এই ধারনাগুলোই যথেষ্ঠ হচ্ছেনা কিংবা খুব সহজে সমস্যাগুলো সমাধান করা যাচ্ছে না। আরো কিছু ধারনার প্রয়োজন হচ্ছে। এজন্য এই অধ্যায়ে আমাদের পদার্থবিজ্ঞানের পড়াশুনায় কাজ, শক্তি, ক্ষমতা সম্পর্কিত ধারনাগুলোও যুক্ত হবে যেগুলো ব্যবহার করে গাণিতিক অনেক সমস্যা আরো সহজে সমাধান করা যাবে।
আমাদের বাসার আলমারীটাকে ঠেলে সরানো, রাস্তায় আটকে যাওয়া একটা গাড়িকে ঠেলা, এক বাক্স বই মেঝে থেকে উপরের সেলফে তোলা, এগুলো দৈনন্দিন জীবনে বেশ কষ্টসাধ্য কাজ। এই ঠেলা, এদিক সেদিক নাড়ানো, এরকম নানা কিছু করে একটু পরিশ্রম করাঃ প্রতিদিনকার জীবনে কাজ বলতে আমরা এই ব্যাপার গুলোকেই বুঝিয়ে থাকি। অর্থাৎ যেকোনো কিছু, যেটা করতে পেশি শক্তি কিংবা মানসিক চেষ্টার প্রয়োজন হয়। তবে দৈনন্দিন জীবনে কথা-বার্তায় ব্যবহৃত কাজ আর পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় ব্যবহৃত কাজের মধ্যে পার্থক্য আছে। কাজ করতে হলে শক্তি লাগে। এই শক্তির আবার নানা রূপ আছে। তাছাড়া কোনো কাজ কে কতটুকু সময়ের মধ্যে শেষ করল সেটার উপর নির্ভর করে কার ক্ষমতা কতটুকু। এই অধ্যায়ে আমরা পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় কাজ, শক্তি, ক্ষমতা, এদের সংজ্ঞা, এদের সাথে জড়িত নানা বিষয়াদি এবং এ সম্পর্কিত গাণিতিক সমস্যা সমাধান কিভাবে সমাধান করতে হয় সেসব জানব।
কাজ
ধরা যাক সকাল থেকে আমি একটা বড় ট্রাকে একটা একটা করে অনেকগুলো ইট উঠানোর কাজ করছি। এটা করতে করতে এক সময় আমি ক্লান্ত হয়ে পড়ব, আমার ক্ষিধা লাগবে। আরো শক্তি পাওয়ার জন্য তখন আমাকে খাবার খেতে হবে। যেভাবেই হোক না কেন এই খাবারে থাকা শক্তিই পরবর্তীতে ট্রাকের উপরে উঠানো ইটে সঞ্চারিত হয়েছে। আর এই প্রক্রিয়াটাতে আমরা ‘কাজ’ শব্দটা ব্যবহার করব যার মাধ্যমে খাবারে থাকা শক্তি আমার মধ্যে এবং পরে ইটের মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছে। এ থেকে একটা সাধারণ ধারণা পাওয়া যায় যে শক্তি এক রূপ থেকে অন্য রূপে পরিবর্তিত হয়। কাজ, শক্তি ও ক্ষমতা সম্পর্কিত এ অধ্যায়ে আমরা শক্তির রূপান্তর সম্পর্কেও ধারনা নেব।
দৈনন্দিন জীবন এবং পদার্থবিজ্ঞান এই দুই ক্ষেত্রেই কাজ শব্দটা ব্যবহৃত হয়। ইটগুলোকে ট্রাকের উপর তোলার ক্ষেত্রে আমরা কাজ করেছি। কিন্তু দৈনন্দিন জীবনে আরো অনেক সাধারণ প্রচেষ্টা বা ক্রিয়াকেও কাজ বলে চালিয়ে দেয়া হয়। যেমন সবাই বলে যে ভালমত পদার্থবিজ্ঞান শেখা অনেক কঠিন কাজ! সাধারণ কথাবার্তায় আমরা এরকম অনেক কিছুকেই কাজ বলে থাকি। কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানে কাজের সংজ্ঞা সুনির্দিষ্টভাবে দেয়া আছে।
ট্রাকে ইট তোলার ঘটনায় ফিরে যাই। ইট তুলি আর যাই তুলি না কেন, বস্তুটা যত বেশি ভারী হবে আমাদের তত বেশি কাজ করতে হবে। কাজটা আরো বেশি কঠিন হবে যখন আমাদের এটাকে আরো বেশি উপরে তুলতে হবে। স্বাভাবিকভাবে আইডিয়া করা যায় যে কতটুকু বল প্রয়োগ করে কতটুকু সরণ হল সেই পরিমান থেকে কাজের পরিমান সম্পর্কে জানা যায়। এই অবজারভেশান থেকেই কাজের সংজ্ঞা দেয়া হয়। আপাতত আমরা ধ্রুব বলের জন্য কাজ সংজ্ঞায়িত করছি। পরিবর্তনশীল বল দ্বারা কৃতকাজ হিসাব করতে হলে ক্যালকুলাস জানা থাকতে হবে। বল যদি ধ্রুব হয় তাহলে কাজের সংজ্ঞাটা হচ্ছেঃ
বল প্রয়োগের ফলে বস্তুর বলের দিকে সরণ হলে বল এবং সরণের গুণফলকে কাজ বলে। (আরো সঠিক সংজ্ঞাটা হলঃ কোনো বস্তুর উপর বল প্রয়োগে বস্তুর সরণ ঘটলে প্রযুক্ত বল ও বলের অভিমুখে সরণের উপাংশের গুণফলকে কাজ বলে। উপাংশ কথাটা নিয়ে বিচলিত হওয়ার দরকার নেই। এটা কেন, কি , কিভাবে এসেছে সেটা সময়মত জানা যাবে। ভেক্টর জানা থাকলে এটা কোনো বিষয়ই না। )
এই কথা থেকে একটা কথা স্পষ্ট যে কোনো বস্তুর উপরে শুধু বল প্রয়োগ করলেই কাজ হয় না। যেমন রাস্তায় আটকে যাওয়া একটা গাড়ির উপর বল প্রয়োগ করা হল। কিন্তু গাড়িটির কোনো স্থানান্তর হল না। সুতরাং প্রযুক্ত বল কোনো কাজ করল না। অতএব বস্তুর উপর বল প্রয়োগ করলে যদি বলের ক্রিয়া রেখায় ঐ বস্তুর স্থানান্তর না ঘটে তবে তা কাজ হয় না।
W=Fs
W= কাজ, F=বল, s=বলের দিকে সরণ
বল এবং সরণের দিক ভিন্ন হলে
W=Fs cosθ= বলের মান × বলের দিকে সরণের উপাংশের মান= সরণের মান × সরণের দিকে বলের উপাংশের মান
θ= বল এবং সরণের দিকের মধ্যকার কোণ।
কাজের একক জুল। 1 Joule= 1 Newton * 1 Meter. এটা একটা স্কেলার রাশি।
শুধুমাত্র তখনই কাজ হবে যখন বল প্রয়োগের ফলে বস্তুর বলের দিকে সরণ হয়। আমি একটা বাক্স হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছি। ভূমি থেকে একই উচ্চতায় অনেকক্ষণ ধরে রাখতে গিয়ে হয়ত আমাকে বল প্রয়োগ করতে হচ্ছে, কিন্তু এখানে কোনো কাজ হচ্ছে না। কারণ বাক্সটাতে বল প্রয়োগ করা সত্তেও (একটা হচ্ছে অভিকর্ষ বল যা নিচের দিকে কাজ করছে, আরেকটা হচ্ছে আমার হাত দিয়ে উপরের দিকে অভিকর্ষ বলের বিপরীত দিকে প্রয়োগ করা বল) এর উপর বা নিচ বরাবর কোনো সরণ না হওয়ার এখানে কোনো কাজ হচ্ছে না। অনেকক্ষন ধরে রাখার ফলে আমরা হয়ত ক্লান্ত হয়ে যেতে পারি। কিন্তু সেটা কেবলই আমার পেশির তন্তু গুলোর ক্রমাগত সংকোচন-প্রসারণের ফলে। এই পেশি সংকোচন-প্রসারনের ফলে যেটা হচ্ছে সেটা হল দেহের একটা অংশ আরেকটা অংশের উপর বল প্রয়োগ করে কাজ করছে। এজন্য আমরা ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছি। কিন্তু যেহেতু বাক্সর উপর বা নিচ বরাবর কোনো সরণ হচ্ছে না সেহেতু বাক্সটার উপর কোনো কাজ ও হচ্ছে না। রাস্তায় আটকে পড়া একটা গাড়িকে আমি অনেকক্ষন ধরে ঠেললাম। কিন্তু গাড়িটার কোনো সরণ হল না। এক্ষেত্রেও কোনো কাজ হবে না। আবার বল যদি সরণের লম্ব দিকে হয় তখনও কোনো কাজ হবে না। W=Fs cosθ এই সূত্রটা থেকে দেখা যায় যে θ যদি 900 বা 2700 হয় তাহলে cosθ=0 হবে এবং কাজও শুন্য। এই দুই মান ছাড়া (অর্থাৎ যখন বলের দিক ও সরণ পরস্পর লম্ব হয়) θ এর অন্য যেকোনো মানের জন্য ধনাত্মক বা ঋণাত্মক যেকোনো মান পাওয়া যাবে যদি F (বল ) এবং s (সরণ ) যেকোনো একটাও আলাদাভাবে শূন্য না হয়।
যে ব্যাক্তি বা বস্তু বল প্রয়োগ করে সেই ব্যাক্তি বা বস্তুই তখন কাজ করে যার উপর বল প্রয়োগ করা হয় সেই বস্তুর উপর। কাজ করার ফলে আসলে কি হয়? কাজ করার ফলে শক্তি এক বস্তু থেকে আরেক বস্তুতে সঞ্চারিত হয়। ধরা যাক আমি একটা বইকে মেঝে থেকে সেলফে তুললাম। এর ফলে বইয়ের উপর কাজ করা হল। এর ফলে বইটার মধ্যে কিছু একটা জমা হল। এখানে বইটার উপর কাজ করার ফলে যে কিছু একটা জমা হল সেটাই হল শক্তি। বইটা যদি নিচে পড়ে তাহলে এটা কাজ করতে পারবে, নিচে থাকা কোনো কিছুর উপর বল প্রয়োগ করে সেটাকে ‘নষ্ট/দুমড়ে-মুচড়ে দেয়া/কোনো ধরনের পরিবর্তন’ করতে পারবে। এই ক্ষেত্রে আমি বইটার উপর কাজ করার মাধ্যমে এর উপর শক্তি জমা করেছি- যার ফলে বইটার মধ্যে একটা সামর্থ্য জমা হল যেটা দিয়ে সে তার নিজের বা তার পরিবেশের মধ্যে পরিবর্তন আনতে পারবে।
কাজ করার মাধ্যমে আমি আমার দেহ থেকে বইটাতে শক্তি সঞ্চারিত করেছি। এভাবেও বলা যায় ‘কাজ হল এমন একটা মেকানিক্যাল মাধ্যম যার মাধ্যমে এক বস্তু থেকে অন্য বস্তুতে শক্তি সঞ্চারিত করা যায়’ (Work is the transfer of energy by mechanical means.) যখন আমি বল প্রয়োগ করে বইটাকে উপরে তুলব তখন আমার হাত বইটার উপর ধনাত্মক কাজ করল। এর ফলে আমার মধ্য থেকে বইয়ের মধ্যে শক্তি সঞ্চারিত হল। আবার বইটা যখন আমি হাতে ধরে নিচে নামাই তখন আমার হাত দ্বারা কৃতকাজটা হচ্ছে ঋণাত্মক।
ক্ষমতা
আমরা এতক্ষন কাজ সম্পর্কে অনেক কিছু বলেছি। কিন্তু কাজ করার সময় সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। দৈনন্দিন জীবনে আমরা দেখেছি যে কোনো নির্দিষ্ট কাজ কেউ তাড়াতাড়ি করতে পারে, কেউ হয়ত এতটা তাড়াতাড়ি করতে পারে না। আমি একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক ইট একই উচ্চতায় তুললাম ২০ মিনিট সময় ব্যয় করে। আরেকজন এই একই সংখ্যক ইট একই উচ্চতায় তুলল ১০ মিনিট সময় ব্যয় করে। তাহলে যে ১০ মিনিটে ঐ একই কাজটা করল তার ক্ষমতা বেশি। কারণ ফিজিক্সের ভাষায় ক্ষমতার সংজ্ঞা হচ্ছেঃ
একক সময়ে যে পরিমাণ কাজ হয় তাকে ক্ষমতা বলে।
ক্ষমতা (p) =কাজ (w)/ সময় (t); (p=w/t); ক্ষমতার একক ওয়াট (watt).
1 watt= 1 Joule/ 1 secend
শক্তি
শক্তি আসলে কি? দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ ধারণায় যার শক্তি যত বেশি সে তত বেশি কাজ করতে পারে। ধরা যাক আমি একটা দৌড় প্রতিযোগীতায় অংশ নিয়েছি। আমার যদি শক্তি বেশি থাকে তাহলে আমি আরো বেশি দ্রুত দৌড়ে আরো বেশি দূর যেতে পারব , কিংবা আরো বেশি উপরে লাফ দিতে পারব। বস্তু কিংবা ব্যাক্তি সবকিছুরই শক্তি আছে। আবার এই শক্তির নানা রূপও আছে। একটা বড় পাথরের টুকরা যখন অনেক উপর থেকে নিচে পড়ে তখন সেই পড়ন্ত পাথরের যথেষ্ট শক্তি আছে একটা গাড়ির সামনের অংশের কাচ ভেঙ্গে চুরমার করে দেবার জন্য। আমরা যখন ঢিল ছুড়ি সেই ঢিলেরও শক্তি আছে যেটা দিয়ে পাথরটা বাসা বাড়ির জানালার কাঁচ ভেঙ্গে দিতে পারে কিংবা আঘাত করে কোনো কিছু সরিয়ে দিতে পারে। সাধারণভাবে আমরা এভাবে বলতে পারি যে যদি কোনো বস্তু তার চারপাশের কিংবা তার নিজের কোনো পরিবর্তন করতে পারে তাহলে তার শক্তি আছে। এই অধ্যায়ের জন্য শক্তির সংজ্ঞাকে আমরা প্রচলিত ভাবেই সংজ্ঞায়িত করব। আর সেটা হচ্ছে ‘Ability to do work’ অর্থাৎ কাজ করার সামর্থ্যকে শক্তি বলে। তবে শক্তির বিভিন্ন রূপ আছে। সব ধরনের শক্তির জন্য এটাও খুব গ্রহনযোগ্য একটা সংজ্ঞা না। এই সংজ্ঞাটা মূলত যান্ত্রিক শক্তির জন্য প্রযোজ্য।
শক্তির বিভিন্ন রূপ আছে। কিন্তু কি সেই বিভিন্ন রূপ তার একটা ধারণা দেয়া দরকার। কোনো বস্তু তার নিজের বা চারপাশের পরিবেশের কোনো পরিবর্তন করতে পারলে ধরে নিতে হবে যে তার মধ্যে শক্তি আছে। ( energy is the ability to change an object or its environment) এখন এই পরিবর্তন অনেকভাবেই হতে পারে। একটা চলন্ত গাড়ি চলতে গিয়ে কোনো কিছুর সাথে ধাক্কা খেয়ে ঐ বস্তুর আকৃতি পরিবর্তন করে ফেলতে পারে। যে শক্তিটা গাড়িকে গতিশীল করছে সেই শক্তি সাধারণত গাড়ি চালানোর তেল বা গ্যাসোলিনের রাসায়নিক বন্ধনের মধ্যে সঞ্চিত থাকে। এই শক্তি আরো নানা ভাবে সঞ্চিত থাকতে পারে। একটা ভারী বস্তু অনেক উপরের শেলফে রাখা হলে সে বস্তুটার মধ্যে যথেষ্ট পরিমান বিভব শক্তি জমা হয়। বস্তুটা যখন নিচে পড়ে তখন এই সঞ্চিত বিভবশক্তি গতিশক্তিতে পরিবর্তিত হয় এবং নিচে যে বস্তুটার উপর পড়ে সেটার উপর কাজ করতে পারে। (এই অধ্যায়ের বিস্তারিত পড়া যখন আমরা পড়ব তখন আমরা গাণিতিকভাবে দেখব যে উপরে থাকা একটা বস্তু যখন ক্রমাগত নিচে পড়তে থাকে তখন উচ্চতার পরিবর্তনের সাথে সাথে এর বিভবশক্তি কিভাবে গতিশক্তিতে রুপান্তরিত হয়।) আবার একটা স্প্রিং বা রাবার ব্যান্ডকে টেনে ধরে ছেড়ে দিলে সেটা অন্য আরেকটা বস্তুকে গতিশীল করে দিতে পারে। তাহলে দেখা যাচ্ছে প্রসারিত বা টেনে ধরে রাখা স্প্রিং/রাবারের মধ্যেও এক ধরনের শক্তি জমা হয় যেটা অন্য বস্তুর উপর কাজ করতে পারে। শক্তির নানা রূপ আছে। এর মধ্যে বিশেষকরে বিভবশক্তি ও গতিশক্তি নিয়ে এই অধ্যায়ে আমরা আলোচনা করব।
পদার্থবিজ্ঞানে বিভবশক্তি (Potential energy) বলতে কোন বস্তু বা কোন ব্যবস্থা তার স্বাভাবিক অবস্থা বা অবস্থানের বা বস্তুর কণাসমুহের বিন্যাসের পরিবর্তনের জন্য কাজ করার যে সামর্থ্য অর্থাৎ শক্তি লাভ করে তা বোঝানো হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় বাহ্যিক বল প্রয়োগের মাধ্যমে স্প্রিং-এর একপ্রান্ত টেনে এর দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি করা হলে বা অভিকর্ষের বিরুদ্ধে কোন বস্তুকে ভূমি থেকে উত্তোলন করা হলে কোন বস্তু বিভবশক্তি অর্জন করে। বলের বিরুদ্ধে কাজ করে কোন বস্তুকে অন্য অবস্থা বা অবস্থানে আনতে যে পরিমান কাজ করা হয় তা বস্তুর মধ্যে বিভবশক্তি রূপে জমা থাকে। বস্তুটি যখন আবার তার পূর্বের অবস্থা বা অবস্থানে ফিরে আসে তখন বস্তুটির ঐ পরিমান বিভবশক্তি অন্য শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। অভিকর্ষজ বিভবশক্তি পরিমাপ করা হয় PE=mgh এই সূত্র দ্বারা। (PE= potential energy, m=ভর g=অভিকর্ষজ ত্বরণ h=উচ্চতা)
একটা চলন্ত বস্তু অন্য একটা বস্তুকে আঘাত করে সেই বস্তুর উপর কাজ করতে পারে। ধরা যাক একটা গাড়ি স্থির আছে। এখন আমরা ইঞ্জিন চালু করে এক্সিলেটার চেপে এর মধ্যে গতির সঞ্চার করলাম। গাড়ি চলছে। গতিশীল অবস্থায় গাড়িটির মধ্যে কাজ করার সামর্থ্য জমা হল। অর্থাৎ গাড়িটির মধ্যে শক্তির সঞ্চার হল। গতির ফলে কোনো বস্তুর মধ্যে যে শক্তি জমা হয় সেটাকে বলে গতি শক্তি। গাড়িটির বেগ এবং ভর জেনে এই গতিশক্তি সুনির্দিষ্টভাবে বের করা যায়।
লোহার বড় গোলা দিয়ে একটা ইটের দেয়ালকে আঘাত করলে সেটা ভেঙ্গে পড়ে, একটা হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে করে আমরা কাঠের মধ্যে পেরেক ঠুকি, একটা চলন্ত বস্ত আরেকটা বস্তুকে আঘাত করলে সেই দ্বিতীয় বস্তুটার কিছুটা সরণ ঘটে। তাহলে দেখা যাচ্ছে একটা চলন্ত বস্তু কাজ করতে পারে। এভাবেও বলা যায় যে চলন্ত বস্তুর কাজ করার সামর্থ্য আছে যেটাকে আমরা শক্তি বলি। চলন্ত বস্তুর এই গতিশীলতার জন্য এর মধ্যে যে শক্তির উদ্ভব হয় সেটাকে গতিশক্তি বলে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই যে চলন্ত গাড়ির মধ্যে শক্তি জমা হল, সেই শক্তি কোথা থেকে এল? এই শক্তি কিন্তু এমনি এমনি আসে নি। যদি এমনি এমনি আসত তাহলে গাড়ি চালানোর তেল-গ্যাস নিয়ে আমাদের কোনো দুশ্চিন্তাই থাকত না।
আমরা জানলাম যে গতি শক্তি কি। এবারে আমাদের জানতে হবে যে কিভাবে একটা চলন্ত বস্তুর গতিশক্তি হিসাব করা হয়। অর্থাৎ কত ভরের একটা বস্তু ঠিক কত বেগে চললে এর মধ্যে উদ্ভব হওয়া গতিশক্তির পরিমাণ কত। m ভরের একটা বস্তু যদি v বেগে সরলপথে চলে তাহলে এর গতি শক্তির পরিমাণ (1/2)mv2 . এই সূত্রটা আমরা হঠাৎ করে লিখে দেই নি। এর প্রতিপাদন আমরা পরে পড়ব। গতিশক্তি সংক্রান্ত বিভিন্ন গাণিতিক সমস্যা সমাধানে এই সূত্রটা আমাদের বার বার লাগবে।
এতটুকু পড়ার পর আমরা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা জিনিস শিখব। এটা হল কাজ-শক্তি উপপাদ্য। একটা বস্তুর উপর নেট যতটুকু কাজ করা হয় বস্তুটার গতিশক্তির ঠিক ততটুকু পরিবর্তন হয়।
আরেকটা গুরত্বপূর্ণ তথ্য হচ্ছে শক্তির সৃষ্টি কিংবা বিনাশ নেই। মহাবিশ্বের মোট শক্তির পরিমান নির্দিষ্ট। এটাকে বলা হয় শক্তির নিত্যতা সূত্র। শক্তি লেখচিত্র এবং পড়ন্ত বস্তুর ক্ষেত্রে বিভবশক্তি ও গতিশক্তির ক্রম রূপান্তরের গাণিতিক প্রমাণের মাধ্যমে এটা খুব সুন্দরভাবে করা যায়। কাজ, ক্ষমতা এবং শক্তির বিস্তারিত লেকচারগুলোতে এই নিয়ে আমরা অনেক মজার মজার বাস্তব উদাহরণ সহ আলোচনা করব।
এখানে নানা ঘটনায় শক্তির রূপান্তরের কিছু উ্দাহরণ দেয়া হলঃ
0 মন্তব্য(গুলি) to পদার্থবিদ্যা মেকানিক্স-লেকচার ৭ (কাজ, শক্তি, ক্ষমতা প্রাথমিক ধারনা)